বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪
spot_img
Homeআন্তর্জাতিকসমাজের নতুন আতঙ্ক কিশোর গ্যাং

সমাজের নতুন আতঙ্ক কিশোর গ্যাং

কিশোর গ্যাং সদস্যরা প্রতিনিয়ত নানা অপকর্মে লিপ্ত। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত হাতিরঝিল এলাকা থেকেই ২৩০ কিশোরকে আটক করেছি। এদের মধ্যে ডিএমপি অধ্যাদেশ অনুযায়ী ২৬ জনকে আদালতে পাঠানো হয়। মাদকসহ নানা অপরাধে ১২ জনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হয়। অন্যদের সতর্ক করে অভিভাবকদের জিম্মায় হস্তান্তর করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কিশোর গ্যাং সদস্যদের অপকর্মের শেষ নেই। এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা সংঘটিত করছে না। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ কাজ করছে না। গ্রেফতারের পর অপরাধের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা থাকছে নির্বিকার।

সম্প্রতি ভায়াবহ মাদক এলএসডিসহ কয়েকজনকে গ্রেফতারের পরেও তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি। এমনকি সাংবাদিকরা যখন তাদের ছবি তুলছিলেন তখন তাদের কাউকে কাউকে হাসতে দেখা যায়। যেন স্বতপ্রণোদিত হয়ে তারা ফটোসেশন করছে।

কিশোর গ্যাং সদস্যরা যেসব অপকর্ম করছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- হত্যা, মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, যৌন হয়রানি, বিভিন্ন কাজে কমিশন গ্রহণ, শ্লীলতাহানি, মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া, উচ্চৈঃস্বরে হর্ন বাজানো, পাড়া-মহল্লায় দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া, ধর্ষণ ও অস্ত্র ব্যবসা।

এছাড়া মাদক সেবন, জমি দখল, হাত-পায়ের রগ কাটা, ফেসবুক-ইন্টারনেটে সমাজবিরোধী কার্যক্রমে যুক্তসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকে তারা।

তাদের পরনে থাকে টি-শার্ট, জিনসের প্যান্ট। চোখে সানগ্লাস। চুলে নিত্যনতুন স্টাইল। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে দামি লাইটারে ধরায়। সিগারেটের ধোঁয়া ছোড়ে পথচারী বা তরুণীদের দিকে। উচ্চৈঃস্বরে হিন্দি, ইংরেজি গান গায়। রাত বাড়লেই অভিজাত এলাকায় শুরু হয় তাদের মোটরসাইকেল ও কার রেসিং।

২৭ মে রাতে কুমিল্লায় উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে এক স্কুলছাত্রের হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে গ্যাং সদস্যরা। ওই স্কুলছাত্রের নাম নওশাদ কবির মজুমদার নাহিদ। সে কুমিল্লা জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। এর আগে কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুলের দুই ছাত্রসহ ওই নগরীতে কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে।

৩০ মে নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপ লাঠিসোটা নিয়ে একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর হামলা চালায়। স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাঠিসোটাসহ দুই গ্রুপের ৫ কিশোরকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের আদালতে পাঠানো হয়।

অপহরণের ৩ দিন পর ২১ মে কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে অর্ধগলিত অবস্থায় মুমিন (১৬) নামের এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনাতেও কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানিয়েছেন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর।

তিনি জানান, মোটরসাইকেল ভাড়া নেওয়ার কথা বলে তাকে বাসা থেকে ডেকে এনে হত্যার পর মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায় কায়সারের নেতৃত্বাধীন গ্যাং সদস্যরা।

এক প্রশ্নের উত্তরে মুক্তা ধর বলেন, শুধু কক্সবাজার বা ঢাকাতেই নয়, সাভার, গাজীপুরসহ সারা দেশেই গ্যাং সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অতি সম্প্রতি তারা বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে।

আশার বিষয় এই যে, কোনো ঘটনা ঘটিয়েই তারা পার পাচ্ছে না। দ্রুতই তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে গ্যাং সদস্যরা অপকর্মে লিপ্ত হতে না পারে, সে জন্য শিগগিরই বিশেষ অভিযান চালানো হবে বলে তিনি জানান।

ঢাকা মহানগর গোয়ন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার  বলেন, শিশুদের খেলার মাঠ নেই। নেই সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা। শিশু-কিশোরদের বখে যাওয়ার ক্ষেত্রে এ দুটি কারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, প্রতি ৪-৫ বছরে সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু অনেকে এ সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছে না। সমাজে ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির লোক বসবাস করছেন। সবার সাধ একই ধরনের হলেও সবার সাধ্য এক নয়। এ নিয়ে সংঘাত তৈরি হচ্ছে। এ থেকেও কিশোর গ্যাং তৈরি হয়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, কিশোর গ্যাং সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করে সবাইকে নিয়ে। এর মাধ্যমে তারা নতুন নতুন অপরাধে যুক্ত হচ্ছে।

যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে ধর্ষণ ও খুন-খারাবির মতো ঘটনাও তারা ঘটাচ্ছে। প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ ম্যাধ্যম ব্যবহার করে তারা প্রতারণায় যুক্ত হচ্ছে। এলএসডি, আইসের মতো ভয়াবহ মাদকে আসক্ত হচ্ছে তারা। তারা মাদকে ঢুকে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। ভয়াবহ গেমস এবং বিট কয়েনের সঙ্গে।

এক প্রশ্নের উত্তরে হাফিজ আক্তার বলেন, কিশোর গ্যাং সদস্যদের তৎপরতা বন্ধে এ মুহূর্তে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। গ্যাং সদস্যদের তালিকা হালনাগাদ করছি।

আমাদের কাজ মূলত কোনো অপরাধ সংঘটন হওয়ার পর। তারপরও বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে কিশোরদের কাউন্সিলিং করতে ডিএমপি কমিশনার এরই মধ্যে নির্দেশ দিয়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় এই যে, নানা অপরাধে যেসব গ্যাং সদস্যদের আমরা গ্রেফতার করছি তাদের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ দেখছি না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান অয়োজনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনার পাশাপাশি শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ভূমিকা পালন করতে হবে। গণমাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও অনুষ্ঠান পরিচালনার পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র শিশু-কিশোরদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

পুলিশিং জোরদার করাসহ পাড়া-মহল্লায় অভিভাবক, স্থানীয় প্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠন করে কিশোর গ্যাংবিরোধী কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। গ্যাংয়গুলোর হটস্পট চিহ্নিত করে থানা পুলিশকে নিয়মিতভাবে অভিযান চালাতে হবে। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সংখ্যা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

spot_img
এই বিভাগের অনান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ