মুমিন জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি বা তাঁর ভালোবাসা অর্জন। প্রকৃত মুমিনের সব কর্মপ্রচেষ্টা এর ওপরই নির্ভর থাকে। সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা লাভের এই ব্যাকুলতা থেকে আল্লাহর বান্দাগণ ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকে প্রতিনিয়ত, আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ করে। এমনকি আল্লাহর ভালোবাসায় নিজেদের জীবন বিসর্জন দেয় আত্মত্যাগী শহীদরা।
কারণ যে আল্লাহকে ভালোবাসে ও সন্তুষ্ট রাখে, আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন ও তার ওপর সন্তুষ্ট হন। আসমানের ফেরেশতারাও তাকে ভালোবাসেন। জমিনেও তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেন। পরিশেষে ওই ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভে ধন্য হন।
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে মুমিনের অন্যতম পদক্ষেপগুলো এখানে তুলে ধরা হলো—
এক. কোরআনচর্চায় মনোযোগী হওয়া : পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহর কালাম। এটি মানুষকে আলোকিত করে। মানুষকে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনে সাহায্য করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানরা যেন তা অনুধাবন করে। ’ (সুরা : সদ, আয়াত : ২৯)
দুই. আল্লাহর গুণবাচক নামসমূহের জিকির করা : অন্তরে সর্বদা আল্লাহর পবিত্র নামসমূহ, গুণাবলি ও তাঁর মারেফতের ব্যাপারে ভাবনা তৈরি করা। যে বান্দা তাঁর নাম, গুণ ও কর্মবিধির পরিচিতি পাবে সে নিঃসন্দেহে তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করবে। তাঁর মহব্বতের সামনে নিজেকে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হবে। কারণ তাঁর নাম ও গুণাবলি অতুলনীয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সে নাম ধরেই তাঁকে ডাকো। আর তাদের বর্জন করো, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শিগগিরই পাবে। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৮০)
তিন. আল্লাহর কাছেই মুখাপেক্ষী হওয়া : আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম একটি উপায় হলো অন্তরে এ বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। এই অনুভূতি সর্বদা অন্তরে জাগ্রত রাখা। তবেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁর অমুখাপেক্ষিতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর কাছে মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত। ’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ১৫)
চার. পুণ্যবানদের মজলিসে অংশগ্রহণ : পুণ্যবানদের মজলিসে অংশগ্রহণ হিদায়তিপ্রাপ্তির অন্যতম মাধ্যম। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিও পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। ’ (সুরা : কাহাফ, আয়াত : ২৮)
হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা যখন জান্নাতের বাগানগুলোর পাশ দিয়ে যাবে সে সময় সেখান থেকে পাকা ফল তুলে নেবে। লোকজন প্রশ্ন করল, জান্নাতের বাগানগুলো কী? তিনি বলেন, জিকিরের মজলিস। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫১০)
পাঁচ. নফল ইবাদতের প্রতি যত্নবান হওয়া : ফরজ, ওয়াজিব আমলগুলোর পাশাপাশি নফল ও মুস্তাহাব আমলের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। যদিও ইসলামে নফল আমল পালন করা আবশ্যকীয় বিধান নয়। তবু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে সেসব আমলের বিকল্প নেই।
হাদিসে কুদসিতে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, ‘আমি যা কিছু আমার বান্দার ওপর ফরজ করেছি, তা দ্বারা কেউ আমার নৈকট্য লাভ করবে না। বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। একপর্যায়ে আমি তাকে এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নিই যে আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬৫০২)
ছয়. সর্বদা অন্তরে আল্লাহর স্মরণ : চলতে-ফিরতে, মুখে-অন্তরে সর্বদা আল্লাহর স্মরণ রাখা। আল্লাহর স্মরণ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার সম্পর্কে আমার বান্দার ধারণা মোতাবেক আমি (আচরণ করি)। আমি তার সঙ্গে থাকি, যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে আমাকে তার অন্তরে স্মরণ করে আমি তাকে আমার অন্তরে স্মরণ করি। যদি সে আমাকে মজলিসে স্মরণ করে, আমি তাকে তাদের চেয়ে উত্তম মজলিসে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই, যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক বাহু অগ্রসর হই। যদি সে আমার দিকে আসে হেঁটে, আমি তার দিকে যাই দ্রুত। ’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪০৫)
সাত. পাপ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা : আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম একটি উপায় হলো, পাপ কাজ ছেড়ে দেওয়া। সুতরাং পাপ যতই ক্ষুদ্র হোক পরকালীন শাস্তির কথা ভেবে তা থেকে বিরত থাকা উচিত। রাসুল (সা.) আয়েশা (রা.)-কে বলেছেন, ‘হে আয়েশা, তুমি ছোট ছোট গুনাহ থেকেও নিজেকে রক্ষা করো। কেননা সেটা লেখার জন্যও আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত আছেন। ’ (মিশকাত, হাদিস : ৫৩৫৬)
আট. নিয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন : সুখে-দুঃখে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন মুমিনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। অত্যন্ত উঁচু ও মহৎ এই গুণের মাধ্যমেও বান্দা ও প্রভুর সম্পর্ক মজবুত ও দৃঢ় হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের (আমার নিয়ামত) আরো বাড়িয়ে দেব, আর অকৃতজ্ঞ হলে (জেনে রেখো) আমার শাস্তি কঠোরতম। ’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৭)