বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪
spot_img
Homeফিচারমাত্র ৩০০০ টাকায় ঘুরে আসুন সাজেক ভ্যালি

মাত্র ৩০০০ টাকায় ঘুরে আসুন সাজেক ভ্যালি

পেশাগত ব্যস্ততা ও করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে দূরের কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না। আমরা তিন বন্ধু মানিক, মিজানুর ও আমি। অনেকটা আকস্মিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম, সবুজ ঘেরা পাহাড় দেখতে যাবো। যেইকথা সেইকাজ। লক্ষ্য রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি। তবে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে সাজেক ভ্যালি যেতে হলে অবশ্যই খাগড়াছড়ি হয়ে যেতে হবে।

বৃহস্পতিবার (২৬ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১০টা। রাজধানী ঢাকার কলাবাগান থেকে শান্তি পরিবহনের আমাদের বাস ছুটছে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে। ঘনিষ্ট তিন বন্ধু একসঙ্গে। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছিলো। রাত যখন আড়াইটা সমতল ভূমি ফেনী অতিক্রম করে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির ভূখণ্ডে আমাদের বাস। আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলছে গাড়ি। শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) ভোর সাড়ে ৫টা। আমাদের গাড়ি পাহাড়ি শহর খাগড়াছড়ি। ঘড়ির কাটা যখন ভোর সাড়ে ৬টা তখন আমরা দীঘিনালা বাজারে।

বাস থেকে নেমে একটি রেস্তোরায় ঢুকলাম। ফ্রেশ হলাম। এরপর ডিম, সবজি ও রুটি খেলাম। শীতের ভোর, উষ্ণতা বাড়াতে চা পান করলাম। বলে রাখা ভালো, ঢাকা থেকে সরাসরি সাজেক ভ্যালি কোনো বাস যায় না। উঁচু পাহাড়ি সড়ক হওয়ায় বাস খাগড়াছড়ি শহর অথবা দীঘিনালা পর্যন্ত যায়। তবে ঢাকা থেকে শুধুমাত্র শান্তি পরিবহন ও বিআরটিসি বাস দীঘিনালা বাজার পর্যন্ত যাতায়াত করে থাকে। হানিফ, শ্যামলিসহ অন্যান্য কোম্পানির বাস শুধুমাত্র ঢাকা টু খাগড়াছড়ি শহর পর্যন্ত যায়। যেহেতু গন্তব্য সাজেক ভ্যালি সেহেতু দীঘিনালা পর্যন্ত টিকিট কাটাই ভালো। শান্তি পরিবহনে ঢাকা টু দীঘিনালা ভাড়া মাত্র ৬০০ টাকা।

খাগড়াছড়ি শহর অথবা দীঘিনালা থেকে ছেড়ে যাওয়া চাঁদের অথবা জিপ গাড়ি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাঘাইহাট চেকপোস্ট থেকে সকাল ১০টায় এবং দুপুর ২টায় দু’দফায় সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। প্রতিটি জিপ অথবা চাঁদের গাড়িতে সিট ১৪টি। আপ-ডাউন রিজার্ভ ভাড়া গাড়ি ভেদে সর্বনিম্ন ৭০০০ থেকে ৮০০০ টাকা পর্যন্ত। আমরা ৩ জন। আমাদের অবশ্যই কারো সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। বন্ধু মানিক ভাই, সজ্জন ও বিচক্ষণ মানুষ। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা প্রদীপেবের সঙ্গে তার পরিচয়। প্রদীপেবের নেতৃত্বাধীন ৬ জনের দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখন আমরা ৯ জন। ৭২০০ টাকা দিয়ে ভাড়া করা হলো চাঁন্দের গাড়ি।

সেনাবাহিনীর ১০টার এসকটে পাহাড়ি সরু রাস্তা ধরে সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্যে ছুটছে শতাধিক গাড়ি। কখনও ১০০ ফুট নিচে আবার কখনও ২০০ ফুট উপরে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে প্রবল গতিতে চলছে গাড়ি। টান টান উত্তেজনা। রোমাঞ্চকর ভ্রমণ। পাহাড়ের বুকে উঁচু বাকা সড়ক মোড় ঘোরানোর সময় আঁতকে উঠি সবাই। চাঁন্দের গাড়ি থেকে নিচের দিকে তাকালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির বসতঘরগুলো অনেকটা কবুতরের খোয়ারের মতো দেখায়। মজার বিষয় হলো, সড়কের দু’পাশে উপজাতীয় শিশুরা হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানায় পর্যটকদের। তাদের উদ্দেশ্যে চকলেট ছুড়ে মারেন অনেকে। খাগড়াছড়ি থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং দীঘিনালা থেকে প্রায় ৪৯ কিলোমিটার পথ সাজেক ভ্যালি। দুপুর ১২টায় পৌঁছে গেলাম আমরা।

এবার রিসোর্ট বা হোটেলের কক্ষ ভাড়া করার জন্য ছুটাছুটি। মেঘমালা কাব্য, ঝিঁঝিঁ পোকার বাড়ি, লুসাই রিসোর্ট, মেঘ পর্বত, মেঘ বিলাস, মেঘ মাচাং, সুমই ইকো রিসোর্ট ও চাঁদের বাড়িসহ বাহারি নামের রঙয়ের ঢঙয়ের আবাসিক রিসোর্ট ও হোটেল রয়েছে। এক কক্ষ মাত্র দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় তিন বন্ধু উঠলাম পর্ণদার বাড়ি। ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি। সাজেক ভ্যালিতে ইচ্ছে করলেই যেকোনো খাবার খেতে পারবেন না। সবজি, আলু ভর্তা, ডাল, মুরগির মাংস ও ভাত অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবেই খেতে হবে। দাম প্যাকেজ ১৬০ টাকা। বিকল্প শুধুমাত্র রুটি ও ডিম।

সাজেক ভ্যালির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জেনে রাখা ভালো। সাজেক ভ্যালির উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম এবং পশ্চিমে খাগড়াছড়ি জেলা। রাঙামাটির সর্বউত্তরের ইউনিয়ন সাজেক ভ্যালি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। এর আয়তন ৭০২ বর্গ মাইল। সুউচ্চ সাজেক থেকে রাঙামাটি জেলার অনেক অংশ দেখা যায়। তাই একে রাঙামাটির ছাদও বলা হয়। সাজেকের সর্বত্র মেঘ, পাহাড় আর সবুজে ঘেরা। এখান থেকে দেখা যায় সূর্য উদয় ও সূর্যাস্ত। লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরা উপজাতির বসবাস। দু’টি বড় পাড়া রুইলুই ও কংলাক পাড়া।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উঁচুতে কংলাক পাড়া এবং ১৭২০ ফুট উঁচুতে রুইলুই পাড়া। কংলাক হচ্ছে সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া। চারদিক মেঘের আনাগোনা। বাঁশের মাচানের তৈরি বাড়িঘর। বেশিরভাগ হোটেল রেস্তোরাও বাঁশের তৈরি। টিউবওয়েল নেই। তবে গাড়িতে করে ৫ কিলোমিটার দূর থেকে আনা পানি সরবরাহ করা হয়। দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য প্রতি লিটার পানির দাম এক টাকা। তবে স্থানীয়দের বেশিরভাগ বৃষ্টি অথবা ছোট ছোট ঝর্ণা ও জলধারার পানি ব্যবহার করে থাকেন। বিদ্যুতের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে পর্যটকদের বোতলজাত পানি পান করতে হয়।

আড়াইটার দিকে রুইলুই পাড়ার হোটেল কক্ষ থেকে দলবেঁধে পর্যটকদের সঙ্গে চাঁন্দের গাড়িতে পৌঁছে গেলাম কংলাক পাড়া। লাঠিতে ভর করে ধীরে ধীরে উঠলাম ১৮০০ ফুট উপরে কংলাক চূড়ায়। সেখানে একাধিক টি স্টল রয়েছে। হাফিয়ে ওঠায় বসলাম একটি টি স্টলে। উপজাতি নারীরা-ই পরিচালনা করে থাকেন এসব দোকান। অমায়িক আচরণ। বাঁশের চুঙ্গায় পরিবেশন করা হয় চা। দাম মাত্র ২০ টাকা। মনে হলো ফিরে গেছি আদিম যুগে। চা, কফি ও কলা খেলাম আমরা। প্রতি টুকরা ১০ টাকায় পাওয়া যায় পাহাড়ি সুমিষ্টি পেঁপেঁ। জাম্বুরাও প্রতিটির দাম ৫০ টাকা। আর পাহাড়ি কলা তো আছেই। চারটি কলার দাম ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত।

এখানে রবি ও এয়ারটেল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। বন্ধু মানিক ভাইয়ের মোবাইল দিয়ে ফোন করলাম প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে। জানালাম সবশেষ অবস্থা। একই মোবাইলে বন্ধু মিজানও খোঁজখবর নিলেন পরিবারের। স্মৃতি ধরে রাখতে নানা ঢংয়ে ছবি তুললাম আমরা। কংলাক পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে শিহরিত আমরা। সূর্য যখন পশ্চিম দিগন্তে দুলছে তখন আমরা কংলাক চূড়া থেকে দলবেঁধে ধীরে ধীরে নেমে গেলাম।

এবার চাঁন্দের গাড়িতে আমরা কংলাকের অদূরে হেলিপ্যাডে। সূর্য উদয় ও সূর্যাস্তের বেলাভূমি খ্যাত সাজেক ভ্যালির হেলিপ্যাড। অবলোকন করলাম সূর্যাস্ত। অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই হেলিপ্যাড। পাহাড় ও সবুজ ঘেরা হেলিপ্যাডে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। প্রিয়জনদের সঙ্গে ছবি তোলার হিড়িক। প্রিয়তমা এখানে এসেও করছেন খুনসুঁটি। আমরা ৩ বন্ধু খানিকটা হারিয়ে গেলাম কৈশোরের দুরন্তপনায়। এখানে রয়েছে অস্থায়ী মুখরোচক খাবারের দোকান। ফিশ ফ্রাই, ডিম চপ, আলু চপ, পেঁয়াজু, ঝালমুড়ি, চানাচুর পাওয়া যায় এখানে। দাম অনেকটা বেশি। বাঁশের চা ও কফিও আছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় ৭টার দিকে আমরা ফিরে এলাম রিসোর্টে।

রুইলুই পাড়া পর্যটকদের আবাসস্থল। রাতের সাজেক যেনো অন্যরকম এক পৃথিবী। হিমেল হাওয়া আর রঙিন আলোতে পাহাড়ের চূড়া সাজেকের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য হৃদয়ে দোলা দেয় এক প্রেমিক মনের। রাতে রেস্তোরাগুলোতে রয়েছে বারবিকিউ এবং বাঁশের চুঙ্গার ভেতর রান্না করা মুরগির মাংস। বাঁশ মুরগি নামে পরিচিত বিশেষ এ খাবারের দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। খেতে পারবেন তিন থেকে চারজন। রুটি অথবা ভাত দিয়ে বাঁশ মুরগির স্বাদ নিতে পারবেন আপনি। অসাধারণ এ খাবারের পর পান করুন বাঁশ চা। রাত ১১টা পর্যন্ত স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে আড্ডার পর চলে এলাম বিছানায়। সারাদিন ক্লান্তি শেষে পাহাড়ের বুকে গভীর নিদ্রায় আমরা।

শনিবার (২৮ নভেম্বর) ভোর ৬টা। বন্ধু মিজান তাড়া দিলো ঘুম থেকে জাগার। আবারো আমরা ভোরের হেলিপ্যাডে। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা বন্দি হলাম। সকাল ৮টার দিকে নাস্তা শেষে ফেরার প্রস্ততি। ঘড়ির কাটা যখন ১০টা, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে সারি সারি শতাধিক জিপ ও চাঁদের গাড়ি। দুপুর দেড়টায় বাঘাইহাট বাজারে যাত্রাবিরতি। পাহাড়ি পেঁপেঁ, ডাব, কমলা খেলাম আমরা। ঠিক আড়াইটার দিকে পৌঁছে গেলাম খাগড়াছড়ি শহরে। রাত ১০টার যাত্রার উদ্দেশ্যে বাসের টিকিট সংগ্রহ করলাম। এরপর দুপুরের খাবার শেষে প্যাকেজ ভাড়া করা চাঁন্দের গাড়ি নিয়ে ছুটলাম মাটিরাঙ্গা উপজেলার সাপমারা গ্রামের রিছাং ঝর্ণা দেখার জন্য। শীতল খনিজ পানি প্রবাহ হচ্ছে বিনাবাধায়। একশ’ ফুট উচ্চতার রিছাং ঝর্ণা দেখার জন্য সিড়ির ২৩৫টি ধাপ পাড়ি দিলাম আমরা। লাঠি ভর করে ধীর গতিতে উঠতে ও নামতে হয়। ১৯৯৩-৯৪ সালে জুম চাষ করতে গিয়ে পাহাড়িদের নজরে আসে প্রাকৃতিক এ ঝর্ণাটি। স্মৃতি ধরে রাখতে এখানে ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি হলাম আমরা।

এবার আমাদের গাড়ি ছুটছে আলুটিলা গুহার উদ্দেশ্যে। খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে আলুটিলা গুহা ৩৫০ ফুট দীর্ঘ। একপাশ দিয়ে ঢুকে নতজানু হয়ে অন্যপাশে বের হতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। ভয়ংকর শ্বাসরুদ্ধকর এক জার্নি। পাথরের পিচ্ছিল তলদেশ ও শীতল পানি প্রবাহমান এ গুহা অন্ধকারাচ্ছন্ন। মশাল অথবা টর্চ লাইট অথবা মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে পাড়ি দিতে হয় এ গুহা। ভয়ংকর মনে হওয়ায় প্রায় ১০ ফুট পথ পাড়ি দিয়ে আবার ফিরে আসি আমি ও মিজান। এ কারণে বন্ধু মানিক ভাই শেষ পর্যন্ত না গিয়ে প্রায় ৫০ ফুট পথ থেকে ফিরে আসেন একইপথে। তবে অন্য সাহসী পর্যটকরা এপাশ দিয়ে ঢুকে বের হন অন্যপাশে।

সন্ধ্যা পৌনে ৬টা। আমরা খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ পার্কে। ঝুলন্ত ব্রিজ এখানকার প্রধান আকর্ষন। রয়েছে বাগান ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে আমরা ঢুকলাম পার্কে। কাঠের তৈরি ঝুলন্ত ব্রিজ পর্যটকদের পদচারণায় মুখর। অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় আমরা পুরো পার্কটি ঘুরে দেখার তেমন একটা সুযোগ পেলাম না। তবে যতটুকু দেখেছি এক কথায়, অসাধারণ। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সভাপতি জিতেন বড়ুয়ার সঙ্গে আমাদের দেখা। তার আতিথীয়তা ভোলার মত নয়। শহরের বেশ কয়েকটি স্থান তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে দেখালেন। খুব ভালো লেগেছে আমাদের। রাত যখন ১০টা, ঢাকার উদ্দেশ্যে খাগড়াছড়ি বিদায় নেয় আমাদের বাস। আনন্দময় ভ্রমণের সৃষ্টি সুখের দিনগুলো মনে পড়বে বার বার।

লেখক: এম এ মান্নান মিয়া (বার্তাকক্ষ সম্পাদক, সময় টিভি)

spot_img
এই বিভাগের অনান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ