সোমবার, নভেম্বর ২৫, ২০২৪
spot_img
Homeপাঠকের কলামকুড়িগ্রামে ছেলে খাবার আনবে, বাঁধে বসে অপেক্ষায় মা

কুড়িগ্রামে ছেলে খাবার আনবে, বাঁধে বসে অপেক্ষায় মা

‘বা পানি উঠছে, বাড়িত তো থাকপেরে পাইনা। ঘরদুয়ার তলে গেইছে। এটে কোনা থুয়া গেল। কইলো তোমরা থাকো। দুখনা ভাত কাঁই এ্যালা দিয়া যায়। তাহে খামো।’বাড়ীতে পানি ওঠায় সন্তানেরা সত্তর্ধ কদভানু বেওয়াকে সকালে বাঁধে রেখে গেছেন।

কয়েক গ্রাস পান্তা পেটে গেছে। এখন ভাতের জন্য বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন তিনি। কোন আক্ষেপ নেই, অভিযোগ নেই। শুধু অপেক্ষায় আছেন সন্তানেরা এই ঝামেলার মধ্যে কখন একটু ভাত নিয়ে আসবে তার জন্য।

বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়ন বাঁধে ঘুরে দেখা গেল এ দৃশ্য। নিম্নাঞ্চলে বাড়িঘরে পানি ওঠায় বাঁধে প্রায় ৪০টি বাড়ি স্থানান্তরিত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন কদভানু বেওয়া।

একটু এগুতে দেখা গেল তাবুর মধ্যে হাড্ডিসার চেহাড়ায় শুয়ে আছেন কাসেম আলী (৬০)। ৯ বছর ধরে প্যারালাইসিসে ভুগছেন তিনি। ছেলে সন্তান নেই। ৫ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন জামাইরা তাকে দেখাশুনা করে।

কাসেম আলীর স্ত্রী মল্লিকা বেগম জানালেন, পাশেই নীলকণ্ঠ কলাতিপাড়ায় বাড়ি। বাড়ীতে গলা অব্দি পানি ওঠায় গতকাল স্বামীকে প্রতিবেশীদের সহযোগিতা নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি জানান, ‘অসুস্থ্য মানুষ নড়াচড়া করতে পারে না। পায়খানা-প্রসাব করা কষ্টকর। পানিতে পরে যাওয়ার ভয়ে বাঁধে নিয়ে এসেছেন। ঘরে খাবার-দাবার নেই। এখন মেয়ে জামাইরা যা দেয় তাই খেয়ে পেট চলে তাদের।’

ডিঙি নৌকায় ব্রহ্মপূত্র নদের একটু ভিতরে ঢুকে দেখা গেল বিবর্ন অবস্থা। সব ধান ক্ষেত দেড় মানুষ নীচে পরে আছে। গাছপালাগুলো যেন পানির উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

হাতিয়া কলাতিপাড়ায় ৩০টি বাড়ির মধ্যে ৭/৮জন পানির মধ্যেই বাড়িতে অবস্থান করছেন। বাকীরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরেছে। এই গ্রামের জয়নালের ছেলে বেলাল হোসেন জানান, ‘১৫/২০দিন ধরে এখনে পানি অবস্থান করছে।

এখন পর্যন্ত কেউ খোঁজখবর নেয়নি। স্ত্রী-সন্তানসহ চৌকি উঁচু করে সেখানে কোন রকমে আছেন তারা। সকালে পান্তাভাত খেয়েছেন। এই বিকেল পর্যন্ত পেটে কিছু পরেনি।

প্রতিবেশী মৃত: একাব্বরের স্ত্রী আখিলা জানান, তোমার করোনা আসি কামকাজ সউগ বন্ধ করি দিলো। ইয়ারমধ্যে আসিল বন্যা। এখন ঘরেও চাল-ডাল নেই। চায়া-টায়া কোন রকমে পেটটা দমায়া আখছি।’

একই অবস্থা এখানকার মৃত: নজিবুদ্দিনের পূত্র খলিলুর রহমান, বেলালের ছেলে হ্নদয়, মৃত: অমূল্যর ছেলে অফিজল ও আফজালের ছেলে কফিলের।এই গ্রামের বেলালের স্ত্রী ছালেহা জানান ‘কোনমতে খাটোত পাটকা (ইট) দিয়া উঁচা করি আছি।

পায়খানা করতে পারিনা। পেসাব করতে পারি না। টিউবলটা তলে গেইছে। কোন রকম উপর থাকি পানি নিয়া খাবার নাগছি। হামার মত আর দু:খ নাই। হাঁস ভাসি গেইছে। চড়াই মরি গেইছে।

দেড় মাস আগে পানিত পরি আমার বাচ্চা পর্যন্ত মারা গেইছে। আমার নাহান দু:খ আর কারো নাই।”পানি বাড়ার সাথে সাথে বাঁধে ৪০টির মত পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

আরো পরিবার আসছে। এখন পর্যন্ত এই পরিবারগুলোর জন্য বিশুদ্ধ পানি ও লেট্রিনের ব্যবস্থা করা হয়নি। এলোমেলো করে কেউ কেউ বাঁধের মুখ জুড়ে তাবু টানলেও দেখার কেউ নেই। যে যেভাবে পারছে এখানে এসে আশ্রয় নিচ্ছে।

শুক্রবার (৩সেপ্টেম্বর) সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোলরুমে কল করে জানা গেল, ব্রহ্মপূত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৫০ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি ব্রীজ পয়েন্টে ২৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

এছাড়াও ব্রহ্মপূত্রের নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে এক সেন্টিমিটার বিপদসীমার নীচে অবস্থান করছে। চলতি বন্যায় এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার হেক্টর রোপা আমন, শাকসবজি ও বীজতলা তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পরেছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ।

এই পরিস্থিতিতে উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে আমার ইউনিয়নে আড়াই থেকে তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়েছে।

বন্যা কবলিতদের জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে ৬ মে.টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি। শুক্রবার বিতরণ করা হবে।
বন্যার্তদের দেখতে আসা উলিুপর উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু জানান, এখন পর্যন্ত ২৫ থেকে ৩০ হাজার পরিবার উলিপুরে পানিবন্দি হয়েছে। বাঁধে আশ্রয় নিয়ে শতাধিক পরিবার।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাঁধে আমরা খুব দ্রুত নলকুপ ও লেট্রিন বসানোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।এদিকে জনপ্রতিনিধার বন্যা কবলিত মানুষের তথ্য জানালেও জেলা ত্রান ও পুনর্বাসন অফিসে যোগাযোগ করে জানা গেল এখন পর্যন্ত পানিতে প্লাবিত হওয়ার তথ্য তাদের কাছে নেই। ফলে সরকারিভাবে বন্যা কবলিতদের তথ্য জানার কোন উপায় নেই।

ফলে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সক্রিয়তা নিয়ে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানালেন, বন্যা দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরসহ তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও ভ্রাম্যমান লেট্রিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও বৃহস্পতিবার থেকে উপ-বরাদ্ধকৃত ২৮০ মে.টন চাল ও ১২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা দুর্গত এলাকায় বিতরণ শুরু হয়েছে।

spot_img
এই বিভাগের অনান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ