মোজাম্মেল আলম ভূঁইয়া- সুনামগঞ্জে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের পানিতে ইতিমধ্যে ডুবে গেছে ১০টি হাওরের বোরো ধান। এঘটনার প্রেক্ষিতে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দূর্নীতি অভিযোগ উঠেছে।
আর এই ফসলহানির ঘটনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
সেই তদন্ত কমিটির আহবায়ক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দা সালমা জাফরিন আজ মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) সকাল থেকে জেলার ধর্শাপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল হাওরসহ
তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গয়ার হাওরের নজরখালী এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ ও ফসল পরিদর্শন করেন এবং স্থানীয় কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন।
এসময় তদন্ত কমিটির সদস্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী এনায়েত উল্লাহ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব
মোবাশসেরুল ইসলাম, সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) দেবজিৎ সিনহা, সুনামগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আওয়ার উল হালিমসহ সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জহুরুল ইসলাম সাথে ছিলেন।
এদিকে ফসলহানি এবং বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসনের ৫ সদস্যের আরো একটি কমিটিও কাজ করছে।
গত রবিবার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন এই কমিটি করেন। তারা আগামী ২৫ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
তদন্ত কমিটি জানায়- গত ৩০ মার্চ ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে সুনামগঞ্জ জেলার নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়।
এরফলে ঝুকিতে পড়ে হাওরের বোরো ফসল। এবং এই অবস্থা অব্যাহত থাকার কারণে গত ২ এপ্রিল সর্ব প্রথম তাহিরপুর উপজেলার নজরখালী বাঁধ ভেঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওরের ফসল ডুবে
যাওয়াসহ একের পর এক ছোট-বড় ১০টি হাওরের ফসলহানি ঘটেছে। তবে জেলার বড়বড় হাওরের ফসল ক্ষতি হয়নি।
তবে হাওর এডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম (হ্যাপ) সংগঠনের নেতারা গত সোমবার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ পৌরশহরের মুক্তিযোদ্ধা পাবলিক লাইব্রেরীতে সংবাদ সম্মেলন করে জানান- হাওরের ফসল রক্ষা
বাঁধ নির্মাণ এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কৃষকদের স্বার্থে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা দেয়। কিন্তু যারা বাঁধ নির্মাণের সাথে জড়িত তারা কৃষক নয়। তাই ওরা নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্থানীয় রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মিলে হাওরের বাঁধ নির্মাণ সিন্ডিকেড গড়ে তুলে।
একারণে অনিয়ম ও দূর্নীতির মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের নামে টাকা অপচয় ও লুটপাট হয়। আর কপাল পুড়ে হাওরের কৃষকদের। বর্তমানে হাওরের কৃষকরা তাদের ফসল রক্ষা করার জন্য নিজ উদ্যোগে বাঁশ, ছাটাই, মাটি দিয়ে বেরী বাঁধ মেরামত করাসহ দিনরাত পাহাড়া দিচ্ছি। আর যারা ফসল
হারিয়েছে তাদের মাঝে হাহাকার বিরাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের কান্না কেউ দেখছেনা।
এই সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের যুগ্ম আহবায়ক শরিফুজ্জামান, সদস্য সচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার, নির্মল ভট্টাচার্যসহ আরো অনেকেই সাংবাদিকদের বলেন- গত ২দিন সুনামগঞ্জ জেলার
৩টি উপজেলার ৫টি হাওর ঘুরে তারা দেখেছেন, প্রভাবশালীরা হাওরের পিআইসি নিজের অধিনে নিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে। একারণে বাঁধের কাজ দায় সারা ভাবে হয়েছে। সময়মতো বাঁধ নির্মাণ শুরু ও শেষ হয়নি, করা হয়নি সঠিক ভাবে
রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি। এখন পাহাড়ি ঢল আসার পর তাদের দৌড়ঝাপ শুরু হয়েছে। একপক্ষ অন্যপক্ষকে করছে দোষারোপ। এবার সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষায় ৭২৭টি প্রকল্পে ১২২ কোটি টাকার বাঁধের কাজ হয়েছে। তবে বাঁধের নির্মাণ কাজ সময়মতো শেষ হয়নি। এজন্য প্রশাসন ও
পাউবো কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নিতে হবে আইনগত পদক্ষেপ। কারণ কৃষকদের দাবী ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ সদর,
তাহিরপুর, ধর্মাপাশা, দিরাই, শাল্লা ও ছাতক উপজেলার ছোট-বড় ১২টি হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে প্রায় ২০হাজার হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে গেছে। সেই ধান হারিয়ে নিঃস্ব প্রায় কয়েক হাজার কৃষক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র সোম বলেন- সুনামগঞ্জে এবার ২লাখ ২২হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ১৩লাখ ৫০হাজার ২২০ মেট্রিক টন। এপর্যন্ত ধান কাটা হয়েছে ২হাজার ৬শ হেক্টর। আর ক্ষতি হয়েছে ৫হাজার হেক্টর
জমির ধান। জেলার বিভিন্ন হাওরে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ধান কাটা শুরু হয়েছে। শ্রমিকদের সাথে মাঠে ধান কাটার মেশিনও রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না আসলে কৃষকরা তাদের ফসল গোলায় তুলতে পারবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন সাংবাদিকদের বলেন- আমরা হাওরের ফসল রক্ষা করার জন্য দিনরাত কাজ করছি। এটা অন্যরকম এক যুদ্ধ। মাঝখানে পানি কিছুটা কমেছিল। কিন্তু এখন আবার বাড়ছে। এজন্য আমরা আতংকিত। আবার ঢল আসলে পানির চাপ বৃদ্ধি পাবে। তখন বাঁধগুলো ঠেকানো মুশকিল হবে। তবে আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।