কে. এম. বেলাল হোসেন স্বপন,’চাটমোহর: যুগে যুগে মনে রাখবার মতো অনেক বার্তা এসেছে এই পৃথিবীতে। মানব সভ্যতার আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত এসেছে অনেক ঝড়ো তান্ডব। বিশ্ববাসিকে করেছে ক্ষতিগ্রস্থ। লন্ডভন্ড করেছে স্বাভাবিক জীবনের চলার গতিকে। অনেকেরই অধরা স্বপ্ন জয় করার সুযোগ মেলেনি। মনের পালে ফুরফুরে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানো যুবক ভুলে গেছে প্রিয়ার কথা। বিপন্ন হয়েছে মানবতা। কেউ কেউ বিশ্বাস হারিয়েছে সৃষ্টির স্রষ্টার উপর। তবুও থেমে নেই জীবন ও জীবিকার সন্ধান।
এক.
‘কোভিড-১৯’ বা ‘করোনা’ এটি মারাত্মক প্রাণঘাতি ভাইরাসের নাম। যদিও সূদুর অতীতে পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ইতিহাস উঠে এসেছে। তথাপিও এই ভাইরাসটি প্রকৃতি প্রদত্ত, নাকি মানবসৃষ্ট? এ প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই! ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে চীনের ওহান রাজ্যে হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস। আগামী ইতিহাসের পাতায় স্মরণিয় করে রাখতে এই ভাইরাসটির নামকরণ হয় ‘কোভিড-১৯’। এই ভাইরাস মাত্র ক’দিনেই চীনের ওহান প্রদেশকে মৃত্যুপুরি’তে পরিণত করে! প্রথমদিকে বিশ্ববাসী চীনের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে আলোচনা সমালোচনার ঝড় তোলেন! অর্থাৎ চীনের মানুষের ধর্মীয় অনুশাসন মজবুত নয়! তারা ইঁদুর-বাদুর, সাপ-ব্যাঙ, পোকা-মাকড় খেয়ে থাকেন! ফলে সে গুলো থেকেই বিশেষ করে ‘বাদুর’ থেকে এই প্রাণঘাতি ভাইরাস মানবদেহে ছড়িয়ে পড়েছে!
পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালের শুরু থেকে পর্যায়ক্রমে করোনা ভাইরাসের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকা, ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, মেক্সিকো, ইটালি, ফ্রান্স, ভারত সহ বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত ১৮৭টি রাষ্ট্রে! মাত্র ৮ মাসের ব্যবধানে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় মৃত্যুর মিছিল! করোনা ভাইরাস বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রাণ কেড়ে নিয়েছে সোয়া ৬ লাখেরও বেশি মানুষের! অপরদিকে বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি ছাড়িয়ে গেছে! করোনা’র প্রভাবে থমকে গেছে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা! সীল করে দেয়া হয় আন্তর্জাতিক জল-স্থল-আকাশ পথ!
দুই.
২০২০ সালের মার্চে এ্যারোপ্লেনে শাহ্ জালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে বাংলাদেশে অবস্থান নেয় ‘করোনা ভাইরাস’ নামের যমদূত! বিগত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ১৮ মার্চ ঘটে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা! একের পর এক বন্ধ হতে থাকে আন্তর্জাতিক উড়ো জাহাজ, জল জাহাজ, ট্রেন ও বাস চলাচল। ছুটি ঘোষণা করা হয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ সকল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ্।
পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হয় অভ্যন্তরিণ বিমান, ট্রেন ও বাস যোগাযোগ। এছাড়াও ছুটি ঘোষণা করা হয় সরকারি, বে-সরকারি অফিস-আদালত, শপিংমল, মার্কেট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, চা-স্টল, হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে সেলুন পর্যন্ত! স্থবির হয়ে পড়ে গোটা দেশ। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আর্থিক অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে জাতীয় প্রণোদনা ঘোষণা করেন সরকার প্রধান। সরকারি কোষাগার থেকে কর্মহীন মানুষের জন্য ব্যাপক খাদ্য সামগ্রী বিতরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, ইন্টারনেট জগতে ব্যাপক সতর্কতামূলক প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও দেশে এ পর্যন্ত অন্তত: প্রায় ৩ হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। মৃত ব্যক্তিদের তালিকায় দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, আমলা, শিল্পপতি সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রয়েছেন!
এখন পর্যন্ত দেশে কমপক্ষে প্রায় সোয়া ২ লাখ মানুষ করোনা শনাক্ত হয়েছেন! আবার এই করোনাকালীন পরিস্থিতিতে বহু জনপ্রতিনিধি, চিকিৎসক, আমলা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীর নাম ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে! মানুষ যখন জীবন রক্ষায় হীমশীম খাচ্ছেন, তখন স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ত্রাণ খাতে হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনাও উঠে এসেছে। আইনি হেফাজতে নেয়া হয়েছে সাহেদ-সাবরিনাদের মতো অর্থলোভী পরজীবিদের!
তিন.
কোভিড-১৯ সংক্রামণের হার ভেদে দেশকে লাল, হলুদ এবং সবুজ তিনটি জোনে বিভক্ত করা হয়। ঐতিহ্যবাহী পাবনা জেলার সদর, ঈশ্বরদী ও সুজানগর উপজেলা লাল জোনের আওতাভূক্ত হলেও আলহামদুলিল্লাহ্ প্রায় তিন লাখ জনসংখ্যা অধ্যূষিত আমাদের চাটমোহর উপজেলা এখন পর্যন্ত সবুজ জোন হিসেবে চিহ্নিত।
এ উপজেলায় বিগত ১৬ এপ্রিল জেলার মধ্যে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হলেও গত তিন মাসে এ উপজেলায় মাত্র ৩৬ জন করোনা শনাক্ত হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে গেছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের তালিকা অনুযায়ী এ উপজেলায় করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা এখনও শূণ্য।
কোভিড-১৯ সংক্রামণ প্রতিরোধে গৃহবন্দি কর্মহীন মেহনতি হতদরিদ্র পরিবার গুলোকে সরকারি ও ব্যক্তিগত অর্থায়নে খাদ্য সামগ্রী বিতরণে উপজেলা পরিষদ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল প্রশংসনীয়। জনসচেতনতায় কিশোর ও যুবকদের ভূমিকা ছিল চোখে ধরার মতো।
জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কোনো ফেসবুক গ্রুপ সড়কে চিত্রাঙ্কন করেছে, অনেকে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে করোনাযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার শপথবাক্য পাঠ করেছে, পথে-ঘাটে-মার্কেটে জীবানুনাশক ছিটিয়েছে, হাট-বাজারে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে অবদান রেখেছে, মাস্ক-স্যানিটাইজার বিতরণ করেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো বেশকিছু কর্মসূচী বাস্তবায়নে সকল সংগঠনকে এক প্লাটফর্মে মিলিত হয়ে কাজ করতে দেখা গেছে। জনসচেতনতায় বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের অনন্য অবদান সর্বত্র ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
চাটমোহরে করোনা প্রভাবে স্থগিত হয় মুজিব বর্ষের সকল আনুষ্ঠানিকতা, দেশ স্বাধীনের পর এই প্রথম বন্ধ রাখা হয় মহান স্বাধীনতা দিবসের বর্ণাঢ্য আয়োজন, প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী বোঁথর চড়ক মেলা হয়নি, বন্ধ রাখা হয় ঐতিহ্যবাহী শাহী মসজিদের কেন্দ্রীয় ঈদের জামাত, উদযাপিত হয়নি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা’র প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতা! শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো বন্ধ থাকার কারণে এই প্রথম শিক্ষার্থীরা নিজের পড়ার টেবিলে বসে পরীক্ষা দেয়ার মতো বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে! এক কথায় করোনা ভাইরাস সর্বক্ষেত্রে নতুন ইতিহাস গড়ে চলছে।
চার.
কোভিড-১৯ এর প্রভাব সারাবিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত সকল রাষ্ট্র গুলো করোনা’র ভয়াল থাবায় তছনছ হয়ে গেছে! মানুষের মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছে, একই সাথে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা! সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ব্যবসায়ীরা! দেশের বড় বড় শিল্প-কারখানায় উৎপাদন সীমিত করা হয়েছে, ইতোমধ্যে বাতিল হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার আন্তর্জাতিক অর্ডার! উৎপাদনশীল শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম! ফলে চলছে শ্রমিক ছাঁটাই, বাড়ছে বেকারত্ব সমস্যা। কর্মহীন শ্রমিকেরা বাধ্য হয়ে শহর থেকে ফিরে আসছে গ্রামে।
যমদূতরূপী করোনা ভাইরাস যে গতিতে ধেয়ে আসছে, তাতে আমরা অনেকেই আক্রান্ত হবো, এটাই স্বাভাবিক! তবে করোনার প্রভাবে প্রাণ হারাবো? নাকি রক্ষা পাবো, এটা একমাত্র ভাগ্য বিধাতাই জানেন। এমনও তো হতে পারে যে, হয়তো ইতোমধ্যে অনেকের দেহে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে গেছে, উপসর্গ না থাকায় অনেকে হয়তো টেরই পাননি!
বিশ্বজুড়ে চলছে করোনা প্রতিষেধক আবিস্কারের প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও পিছিয়ে নেই। হয়তো বাংলাদেশী চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের আবিস্কার ‘এক চিমটি লবন-দু’মুঠো গুড়/চিনি-আধা লিটার জল’ মিশ্রিত খাবার স্যালাইন, যেভাবে কলেরা মহামারীকে রুখতে সক্ষম হয়ে ছিলন! আশারাখি তেমনি একদিন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অনন্য আবিস্কার মাত্র পঞ্চাশ টাকার ঔষধ সুস্থ করে তুলতে পারবে এক একজন করোনা রোগিকে।
সেই সু-সময় যতদিন না আসছে, ততদিন প্রচলিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আসুন সকলে প্রতিদিন বার বার সাবান দিয়ে অন্তত: ২০ সেকেন্ড ঘঁষে হাত পরিস্কার করি, সর্বদা সর্বত্র মুখে পরিস্কার পরিসুদ্ধ মাস্ক ব্যবহার করি এবং শারীরিক দূরত্ব রজায় রেখে পথচলি। নিজে নিরাপদ থাকি, সকলকে নিরাপদ থাকতে উদ্বুদ্ধ করি। পরিশেষে জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী নচিকেতা’র কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে’।
লেখক: ‘কে. এম. বেলাল হোসেন স্বপন’
সম্পাদক, সাপ্তাহিক সময় অসময়
চাটমোহর, পাবনা।