বশির আলম ( প্রতিবেদক) শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার। এটি শুধু একটি নামই নয়, একটি আদর্শ। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, জনপ্রিয় রাজনীতিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণমানুষের অতি কাছের মানুষ। ছিলেন মেহনতি শ্রমিকের বন্ধু। তাঁর আলোয় আলোকিত হয়েছিল গোটা গাজীপুর তথা বাংলাদেশের রাজনীতি। হয়ে ওঠেছিলেন তাঁর কালে কিংবদন্তি। ১৯৫০ সালের ৯ নভেম্বর গাজীপুরের হায়দারাবাদ গ্রামে জন্ম আহসান উল্লাহ মাস্টারের। আমৃত্যু তিনি
কাটিয়ে গেছেন কুঁড়েঘরে। ঘুণেধরা সমাজ আর পচনশীল রাজনীতির ¯্রােতে তিনি ভাসাননি গা। ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম। নীতি-নৈতিকতা ছিল তাঁর অনন্য সম্পদ। ফলে সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতিকে পেছনে ফেলে তিনি অবিরাম ছুটেছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে। জয় করেছেন তাদের মন, ভালোবাসা।বাঙালির সম্মান, গৌরব, মূল্যবোধ ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে যে সকল রাজনীতিবিদ নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে একজন শহীদ আহসান উল্লাহ
মাস্টার। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তিনি। তাঁর সংগ্রাম ছিল শ্রমিক-কৃষক- মেহনতি জনতার জন্য। তাঁদের জন্যই তিনি রাজনীতি করেছেন। খেটে খাওয়া মানুষসহ সবাইকে আপন করে নেয়ার এক দুর্লভ গুণ তাঁর মধ্যে ছিল। শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে এবং তাদের স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টায় কোনোদিন তাঁকে পিছপা হতে দেখা যায়নি। শ্রমবিষয়ক আন্দোলনে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা হলে, সেই মামলার আইনি লড়াইয়ের জন্য আইনজীবী
নিয়োগ ও মামলা পরিচালনার জন্য তহবিল গঠনসহ বহুবিধ কর্মযজ্ঞের সাথে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার পরিচিত হয়েছেন। ঢাকা-টঙ্গী-গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতিত ও ভোগান্তির শিকার শ্রমিকদের জন্য মামলা বিষয়ক আইনি লড়াইয়ের জন্য নিরলস ছুটে যেতেন তিনি। একজন সৎ ও আদর্শবান রাজনীতিক ও সমাজসেবকের যেসব সদগুণ থাকা উচিত, তার সবই আহসান উল্লাহ মাস্টারের মধ্যে ছিল। শহীদ
আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপি ছিলেন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথে তিনি ছিলেন একজন মাঠের দক্ষ কর্মী। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জননেত্রী শেখ হাসিনার সোনার বাংলা বিনির্মাণ ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। আহসান উল্লাহ মাস্টারের শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গ্রামের হায়দারাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি টঙ্গী হাইস্কুলে ভর্তি হন।
তখন থেকেই টঙ্গীতে ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালে শরিফ শিক্ষা কমিশন ও ১৯৬৪ সালের হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে রাজপথে নামে ছাত্র-ছাত্রীরা। সে সময়ে টঙ্গীতে যে আন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলনে স্কুলপড়ুয়া ছাত্র আহসান উল্লাহ রাজপথে নেমে পড়েন। অংশ নেন মিছিলে। তখন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। টঙ্গী হাইস্কুল থেকে আহসান উল্লাহ ১৯৬৫ সালে
এসএসসি পাস করে ঢাকার পুরনো শহরে অবস্থিত বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজে (তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে) একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা যখন রাজপথে, তখনও ভাওয়ালের এই সন্তান আহসান উল্লাহ রাজপথের একজন সাহসী সৈনিক। এই রাজনীতির লড়াকু সৈনিক হিসেবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে সখ্য গড়ে উঠতে থাকে তাঁর। পড় শোনার
ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতি চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ৬ দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা মিলে আন্দোলন গতি লাভ করে। সে সময়কার উত্তপ্ত টঙ্গীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে যেসব সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় সেগুলো আয়োজনে যাঁদের নাম সর্বাগ্রে আসে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তরুণ ছাত্র নেতা আহসান উল্লাহ । সে সময়কার দিনে টঙ্গী, গাছা ও পুবাইল এলাকায় গণআন্দোলনে তিনি অভূতপূর্ব অবদান
রাখেন ।এরপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন আহসান উল্লাহ মাস্টার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গাজীপুরের টঙ্গীর রেলস্টেশন সংলগ্ন নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন তিনি। জীবনের ২৫টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন শিক্ষকতা পেশায়। শিক্ষকতাকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে পারলেই
সমাজ থেকে চিরতরে দূর হয়ে যাবে অন্যায়-অনাচার, অত্যাচার-অবিচার। শিক্ষার কারণে বদলে যাবে মানুষের ভাগ্য। সে লক্ষ্যেই তিনি কাজ করেছেন নিরন্তর।জনপ্রিয় এই শিক্ষক ১৯৮৩ ও ১৯৮৯ সালে পরপর দু’বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ১৯৯০ সালে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। তৃণমূল থেকে উঠে আসা বহুমাত্রিক এই রাজনীতিক ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিপুল ভোটে গাজীপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত
হন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনিসন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অস্ত্রের ঝনঝনানির বিরুদ্ধেপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন । মাদকের বিরুদ্ধে ছিলতার শক্ত অবস্থান। সব মিলিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছিলেন খুব অল্প দিনেই। কিন্তু ভাগ্যের কি নর্মম পরিহাস, জনপ্রিয় এই রাজনীতিককে চলে যেতে
হলো খুব অল্প দিনেই। অকালেই ঝড়ল তাজা একটি আদর্শের প্রাণ। ২০০৪ সালের ৭ মে শুক্রবার ‘হাওয়া ভবনের’ পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে হত্যা করা হয় আহসান উল্লাহ মাস্টারকে। এজন্য বেছে নেয়া হয় সাবেক টঙ্গী পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠানকে। সম্মেলনে কমিটি ঘোষণা শেষ হওয়ার পরপরই পেছনের দেয়াল টপকে আসা বিএনপির ১০-১২ জনের একদল চিহ্নিত সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি গুলি করে মঞ্চে থাকা আহসান উল্লাহ
মাস্টারকে লক্ষ্য করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নেতাকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন টঙ্গী সরকারী হাসপাতালে। সেখান থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে মহাখালি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও পরে সিএমএইচ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিএমএইচ হাসপাতালে মারা যান আহসান উল্লাহ মাস্টার।দেশ হারায় নন্দিত মানুষকে, যিনি ছিলেন সহ¯্র তরুণের আদর্শ, যিনি ছিলেন জনকল্যাণমুখী চিন্তাধারার একজন রাজনীতিবিদ ও একজন মানুষ গড়ার
কারিগর। তাঁরমৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে হতভম্ব হয়ে পরে গাজীপুর তথা সমগ্র দেশের মানুষ। ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল যেনো ঢেকে যায় কালো চাদরে। কোটি কোটি মানুষ মাতম করতে থাকে এই মহীরুহের অকাল প্রস্থানে। রেল ষ্টেশন, টার্মিনাল, বিমান বন্দর, বাস, ট্রাক, ট্রেন ও আকাশ পথে তখন একই আলোচনা- নক্ষত্রের অকাল বিদায়! ধিক্কার জানাতে থাকে লাখো কোটি মানুষ বিপথগামী সেই ঘাতকদের। কান্নার রোল ওঠে সাধারন মানুষের মধ্যে। শোকের নগরীতে
পরিণত হয় টঙ্গী ও গাজীপুর । প্রতিবাদে সেদিন টঙ্গী-গাজীপুরকে রাজধানী সহ সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় গাজীপুরের শ্রমিক-জনতা। সেদিন বোঝা গিয়েছিল, আহসান উল্লাহ মাস্টার গাজীপুরের মানুষের কাছে কতটা জনপ্রিয়। গাজীপুরের মানুষ কতটা ভালোবাসেন তাদের প্রিয় শিক্ষক, নির্লোভ, নিঃস্বার্থ ও আদর্শবান এ রাজনীতিককে।আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকান্ডে দায়ের করা মামলার বাদি তারই ছোট ভাই মতিউর রহমান মতি এই সময়কে বলেন, এ ঘটনায়
দায়ের করা মামলায় ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল বিচারিক আদালত বিএনপি নেতা নূরুল ইসলাম সরকার, নূরুল ইসলাম দিপু, আনোয়ার ও কানা হাফিজ সহ ২২ জনের মৃত্যুদন্ড, এবং ছয় জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দেন।কিন্তু ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের দেয়া যে পূর্ণাঙ্গ রায়প্রকাশিত হয় সেখানে ৬ জনের ফাঁসি ও ৫ জনের যাবজ্জীবন বহাল রেখে ১১জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া দুই আসামীর মৃত্যু হওয়ায় তাদেরকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া
হয়।অত্যান্ত আশ্চর্যের বিষয় হাইকোর্ট এ মামলার বেশ কয়েকজন পলাতক আসামীকে বেকসুর খালাস দেন। আমরা মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে গাজীপুরবাসীর পক্ষ থেকে জোর দাবি জানাচ্ছি, ২০০৫ সালের বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় যেন বহাল রাখা হয় এবং দ্রুত পলাতক আসামীদের গ্রেফতার করে রায় কার্যকরের মাধ্যমে গাজীপুরবাসীকে যেন কলঙ্কমুক্ত করা হয়। শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের সুযোগ্য সন্তান গাজীপুর ২
আসনের সংসদ সদস্যএবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেল এই সময়কে বলেন, এক যুগের বেশী সময় আগে গাজীপুরবাসীর প্রাণের স্পন্দন শহীদ আহসান উল্লাহ মস্টারকে বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই মামলার রায় কার্যকর করা হয়নি। গাজীপুরবাসীর প্রাণের দাবি এ মামলার রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়।এই মামলায় যেসকল আসামী বিদেশে পালিয়ে
বেড়াচ্ছে তাদেরকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে রাসেল বলেন, আমার বাবা ও আমার পরিবারের জন্য সকলে দোয়া করবেন। আর আমি যেন আমার বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারি সেই দোয়া করবেন সবাই। আহসান উল্লাহ মাস্টারের সঞ্চয় ছিল শুধু মানুষের ভালোবাসা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার লোভ ও লালসার ঊর্ধ্বে থেকে গণমানুষের জন্য কাজ করে
গেছেন। সেবার দ্বারা ও মহৎ কর্মের মাধ্যমে আলোর প্রদীপ হাতে নিয়ে যে মানুষটি অবদান রেখেছিলেন সংগ্রাম-আন্দোলনে, সে মানুষটি আজ তার নিজ গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত। শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার প্রমাণ করেছেন মানুষকে ভালোবাসলে, তাদের জন্য কাজ করলে মানুষ ভালবাসায় তার প্রতিদান দেয়। তাইতো মরেও বেঁচে আছেন আহসান উল্লাহ মাস্টার, গাজীপুর তথা সমগ্র বাংলাদেশের শ্রমিক জনতার মনিকোঠায়।এক যুগ আগে ঘাতকের বুলেট
জীবন প্রদীপ নিভে দিলেও আহসানউল্লাহ মাস্টার আজ আরো দীপ্তময়, আরো বেশি জনপ্রিয়। কিছু কিছু প্রাণ আছে দৃশ্যত মরে গেলেও তাঁর সৃজনীশক্তি ও কর্মযজ্ঞ তাঁকে অমরত্ব দান করে। পৃথিবী ও সভ্যতা তাঁদের দানে হয় সমৃদ্ধ। তেমন একজন ব্যক্তিত্ব শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার।