সবমিলিয়ে ভয় জাগাচ্ছে দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি। সীমান্তের জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই ভালো তো, এই মন্দ অবস্থা চলছে। লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধও তেমন কাজে আসছে না।
কোথাও কোথাও তো লকডাউন চলাকালেই সংক্রমণ বেড়েছে কয়েক গুণ। মৃত্যুও থেমে নেই। সংক্রমণের রাশ টানতে উদ্যোগ থেমে নেই, তারপরও হাসপাতালগুলোতে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না করোনা রোগীদের। শয্যা বাড়িয়ে, হাসপাতালের বারান্দায়, মেঝেতে রেখে সেবা দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইন অনুযায়ী নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১০ শতাংশ অতিক্রম করলে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়, সেখানে হার সাড়ে ১৬ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। সেইসঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু ও শনাক্ত।
গত চব্বিশ ঘণ্টায় পাওয়া গেছে আট সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত। দৈনিক মৃত্যু পৌঁছেছে ষাটের ঘরে। সেটিও গত দেড় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত চব্বিশ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে তিন হাজার ৯৫৬ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
মহামারি শুরু হওয়ার পর মোট আট লাখ ৩৭ হাজার ২৪৭ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। করোনা সংক্রমণে গতকাল মারা গেছেন আরও ৬০ জন। এর আগে গত ৪ মে এর চেয়ে বেশি ৬১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল। করোনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৩ হাজার ২৮২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তথ্য বিশ্নেষণে দেখা যায়, গত ১০ জুন নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ রোগী পাওয়া যায়।
পরের দিন হার প্রায় একই থাকে, সেদিনের শনাক্তের হার ছিল ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। গত শনিবার কিছুটা বেড়ে শনাক্তের হার দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ১২ শতাংশে। গত রোববার ১ শতাংশের বেশি কমে আসে হার, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে ১২ দশমিক ৯৯ শতাংশ রোগী পাওয়া যায়।
অবশ্য পরদিন সোমবার হার আগের দিনের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশে। গত মঙ্গলবার শনাক্তের হার কিছুটা কম পাওয়া গেলেও (১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ) গত চব্বিশ ঘণ্টায় এই হার প্রায় আড়াই শতাংশ বেড়েছে।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তি থেকে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ হারে রোগী পাওয়ার কথা জানানো হয়। মহামারি শুরুর পর নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ হারে রোগী পাওয়া গেছে।
গত ২২ এপ্রিল চার হাজার ১৪ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণের তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর পর থেকে কিছুটা পড়তির দিকেই ছিল শনাক্তের সংখ্যা। মে মাসের ১৫ তারিখে শনাক্ত নেমে আসে ২৬১ জনে।
পরবর্তী সময়ে শনাক্তের সংখ্যা ওঠানামা করলেও গ্রাফে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। গত ১০ জুন সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করে দেশে দুই হাজার ৫৭৬ জন রোগী পাওয়া গিয়েছিল। এর পরের দু’দিন কমতির দিকে ছিল দৈনিক শনাক্ত।
গত ১১ জুন শুক্রবার দুই হাজার ৪৫৪ জন এবং পরদিন শনিবার এক হাজার ৬৩৭ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন। সপ্তাহের পরবর্তী চার দিন শনাক্ত বেড়েছে রকেটগতিতে। গত রোববার দুই হাজার ৪৩৬ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। এর পরদিন সোমবার শনাক্ত রোগীর সংখ্যা অতিক্রম করে তিন হাজারের কোঠা।
সেদিন রোগী শনাক্ত হয় তিন হাজার ৫০ জন। গত মঙ্গলবার তিন হাজার ৩১৯ জন রোগী পাওয়া যায়, ওই সংখ্যাটি তার আগের ৫৩ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। সর্বশেষ গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী আট সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ দৈনিক শনাক্ত দেখল দেশ।
করোনা শনাক্তের পাশাপাশি আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও বেড়েছে গত এক সপ্তাহে। সপ্তাহের প্রথম তিন দিন ওঠানামার মধ্যে ছিল দৈনিক মৃত্যু। গত ১০ জুন করোনা সংক্রমণে ৪০ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এর পরদিন দৈনিক মৃত্যু কিছুটা বেড়ে হয় ৪৩। ওই দিন মোট মৃত্যু অতিক্রম করে ১৩ হাজারের কোঠা। গত শনিবার চব্বিশ ঘণ্টায় মৃত্যু কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩৯ জনে। পরদিন রোববার দৈনিক মৃত্যু আটজন বেড়ে ৪৭ জনে পৌঁছায়। গত সোমবার সংখ্যাটি অর্ধশতক পার করে। সেদিন এক দিনের ব্যবধানে মৃত্যু হয় ৫৪ করোনা রোগীর। অবশ্য মঙ্গলবার মৃত্যু কিছুটা কমে পঞ্চাশে নামলেও গত চব্বিশ ঘণ্টায় এক লাফে সেটি পৌঁছেছে ৬০-এ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত চব্বিশ ঘণ্টায় সারাদেশের ৫১৩টি ল্যাবে ২৩ হাজার ৮০৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ সময়ে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ২৩ হাজার ৯৬৭টি। করোনা সংক্রমণের পুরো সময়ে মোট পরীক্ষা হয়েছে ৬২ লাখ ৪২ হাজার ৭৮৬টি নমুনা। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৪৫ লাখ ৫৫ হাজার ৩০৭টি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৪৭৯টি পরীক্ষা হয়েছে।
গত এক দিনে মৃতদের মধ্যে রয়েছেন ৩৬ জন পুরুষ ও ২৪ নারী। গত চব্বিশ ঘণ্টায় রাজশাহী বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৭ জন মারা গেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। এ ছাড়া করোনা সংক্রমণে খুলনা বিভাগে ১৪ জন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে আটজন, সিলেটে ছয়, রংপুরে চার ও ময়মনসিংহ বিভাগে তিনজন মারা গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি যেভাবে ধাপে ধাপে বাড়ছে, তাতে আরেকটি ঢেউয়ের দিকে যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে স্বাস্থ্যবিধি না মানা, মাস্ক ব্যবহার না করা। একই সঙ্গে সরকার নামমাত্র বিধিনিষেধ আরোপ করে দায়িত্ব শেষ করছে। ওই বিধিনিষেধ মানার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি লকডাউনের সুপারিশ করলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। এতে করে সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে রাজশাহী ব্যুরো জানায়, গত চব্বিশ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিকেলের করোনা ওয়ার্ডে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে করোনা পজিটিভ ছিলেন পাঁচজন, বাকিদের উপসর্গ ছিল। গতকাল রাজশাহীর দুটি পিসিআর ল্যাবে জেলার ৩৭৩টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ১৬২ জন। শনাক্তের হার ৪৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় চলমান লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে।
খুলনা ব্যুরো জানায়, ২৫০ শয্যার খুলনা জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ৭০টি শয্যা চালু করা হচ্ছে। আগামী রোববার থেকে করোনা রোগী ভর্তি করা হবে। এ জন্য মঙ্গলবার থেকে হাসপাতালে অন্য রোগী ভর্তি বন্ধ করা হয়েছে। ময়মনসিংহ ব্যুরো জানায়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চব্বিশ ঘণ্টায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জন করোনা পজিটিভ, বাকিরা ‘সন্দেহভাজন’ ছিলেন।
শিবগঞ্জ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত চব্বিশ ঘণ্টায় ৪৩০টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত ৫৬। শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের।
নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নওগাঁ পৌরসভা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় ৩ জুন থেকে চলমান বিধিনিষেধ তৃতীয় দফায় ২৩ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। জেলায় চব্বিশ ঘণ্টায় ১২৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৮১ শতাংশ। এ সময়ে মারা গেছেন আরও দু’জন।
নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরে আরও দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া গত চব্বিশ ঘণ্টায় ২৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ১২০ জন। শনাক্তের হার ৪১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ফরিদপুর অফিস জানায়, ফরিদপুরে বুধবার ২৫০ জনের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত ৫৬। শনাক্তের হার ২২ দশমিক ৮ শতাংশ। আগের দিনের চেয়ে শনাক্ত কমেছে। দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুর সদর উপজেলায় লকডাউন চললেও সংক্রমণ বেড়েছে তিন গুণ। গত চব্বিশ ঘণ্টায় সদরে ১৯৫টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত ৬০ জন। শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে গত চব্বিশ ঘণ্টায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া জেলায় একই সময়ে ১৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত ১০০। শনাক্তের হার ৫৩ দশমিক ২০ শতাংশ।