সকাল না হতেই শত শত নৌকা হাজির। সূর্যের সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বড় বড় পাত্রে সাজিয়ে রাখা হয় চালের পসরা। অনেকে ধান নিয়েও আসেন। সাতসকালে নৌকায় ভেসে ভেসেই চলে এসব বেচাকেনা।
বরিশালের বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে ঐতিহ্যবাহী এ হাট বসে। প্রায় সারাবছর চালু থাকে এই হাট। সপ্তাহে দুদিন (শনিবার ও মঙ্গলবার) সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে এখানকার কেনাবেচা।
বরিশালের বালাম চালের সুখ্যাতির কথা সবারই জানা। এক সময় বালাম চালের বড় মোকামই ছিল বানরিপাড়ার এ ভাসমান হাট। সেই বালাম চাল প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হতো বানারীপাড়ায়। বালাম ছাড়াও গোদাই, আউশ চাল পাওয়া যায়। মানের দিক থেকে এখানকার চাল অন্যান্য জায়গার চেয়ে উন্নত। এরই মধ্যে বালাম চালের উৎপাদন কমে গেছে। আর এরই সঙ্গে এ ভাসমান হাটের পরিধিও সংকুচিত হয়েছে।
দশ বছর আগেও প্রায় ৫০০টি ছোট-বড় নৌকায় বাঁশের তৈরি বড় বড় পাত্রে চালের পসরা দেখা যেত। এখন এই সংখ্যাটা নেমে এসেছে একশ’রও নিচে। কখনও কখনও পঞ্চাশটির বেশি নৌকা দেখাই যায় না।
জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর ধরে সন্ধ্যা নদীর ওপরে চলমান এই হাটের চিত্র ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। এ হাটে ও সন্নিহিত এলাকায় চাল উৎপাদনকারী- কুটিয়ালদের সংখ্যা এক সময় ছিল প্রায় ২৫ হাজার। নব্বই দশকের শেষ অবধি ৫ সহস্রাধিক পরিবার এ পেশায় নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে এ সংখ্যাটা হাজারে গিয়ে ঠেকেছে।
ধান থেকে চাল—মাঝখানে অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হয়। এই কাজটি যারা করেন, তাদের বলে কুটিয়াল। কুটিয়ালরা ধান কিনে নৌকায় ভিজিয়ে রাখেন। ভোর রাতে তাফালে (বড় চুলা) দিয়ে ডোঙায় (সিদ্ধ করার পাত্র) সিদ্ধ করে পরের দুই থেকে তিন দিন রোদে শুকান। তারপর রাইস মিলে নিয়ে ভাঙালে সুন্দর ঝরঝরে চাল বের হয়।
নিকট অতীতেও উপজেলার ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ এ কাজে জড়িত ছিল। হাট থেকে ধান কিনে বাড়িতে নারী-পুরুষ সম্মিলিত শ্রমে তা প্রক্রিয়াজাত করে চাল তৈরী করে ভাসমান হাটেই বিক্রি করা হয়। তবে তাদেরকে স্থানীয় মহাজনদের হাতে শোষিত ও বঞ্চিত হওয়ায় ধীরে ধীরে বিকল্প পেশা খুজে নিয়েছে অনেকেই।
তবে এখনো বানারীপাড়া উপজেলার নলেশ্রী, দিদিহার, দাণ্ডয়াট, বাইশারী, মসজিদ বাড়ী, আউরা, কালি বাজার, খোদাবকশ, মঙ্গল, চাখার, বাকপুর, ঝিরাকাঠি, ভৈতস্বর, চালতাবাড়ী, চাউলাকাঠি, কাজলাহার, ব্রাহ্মণকাঠি, জম্বু দ্বীপ গ্রামের অসংখ্য কৃষক এই হাটের ওপর নির্ভরশীল।
আউরা গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, আমি আগের রাতে নৌকায় চাল বোঝাই করি। এ কাজে স্ত্রী আমাকে সাহায্য করে। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমি হাটে পৌঁছে যাই। এভাবেই দূরদূরান্ত থেকে আরও আসেন অনেকে। তবে এক সময় এই হাট আরো বেশি জমজমাট ছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই হাটের জৌলুস হারানোর নেপথ্যে রয়েছে সংঘাত। ১৯৮৯-৯০ সালে নানা কারণে মহাজনদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘাত বাধে, যা আন্দোলনে রূপ নেয়। যার প্রভাব পড়ে ধান চালের হাটের ওপর। মহাজনদের সঙ্গে কুটিয়ালদের দীর্ঘস্থায়ী বিরোধে সাধারণ ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় বিকল্প হাটবাজার গড়ে ওঠে।
বিবিসি ট্রাভেল ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সাতটি দর্শনীয় স্থানের কথা প্রকাশ করে। এই ভাসমান হাটটি তার অন্যতম। এ হাট কিছুটা সংকোচিত হলেও, ভ্রমণে ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন।