কুড়িগ্রামে টানা বর্ষন ও লকডাউনে বিপাকে পরেছে খেটে খাওয়া মানুষ। জেলা প্রশাসন করোনা সংক্রমন ঠেকাতে কঠোর লকডাউনকালিন সময়ে নির্দিষ্ট নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যের দোকান ছাড়া সকল দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন।
শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ বিভাগ টহলের পাশাপাশি চেক পোস্টে নজরদারী বাড়ানোয় ঘরের বাইরে প্রয়োজন ছাড়া মানুষ তেমন একটা বের হচ্ছে না।
এদিকে, কড়াকড়ি লকডাউনের ফলে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ পরেছে বিপাকে। বন্ধ হয়ে গেছে শ্রমের হাটগুলো। প্রতিদিন ভোরবেলা বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রম বিক্রির জন্য যারা শহরে আসত, তারাও বাড়িমুখো হয়েছে।
ফলে বিপাকে রয়েছে খেটে খাওয়া এসব মানুষ।
শুক্রবার সন্ধ্যায় শহরের পৌর বাজার থেকে সোনালী ব্যাংক মোড পর্যন্ত ১০/১২ জন আম বিক্রেতা ঝুঁকি নিয়ে আম বিক্রি করছিল।
টহলদল এলেই তারা আড়ালে লুকিয়ে পরতো। চলে গেলে আবার আম বিক্রির ঝুকি। সন্ধ্যা পৌনে ৮টার দিকে কথা হয় এদের একজনের সাথে। দিনমজুর হেলাল (৫০) রংপুরের বদরগঞ্জ পৌরসভার বালুয়াভাটার আলাউদ্দিনের পূত্র।
সেখানেই দিনমজুরী করেন। কয়েকবার কুড়িগ্রামে এসেছিলেন। এবার ২০ ক্যারেট আম নিয়ে এসেছেন। সাথে নিয়ে এসেছেন স্ত্রী ডলি (৪৫) ও ভাগ্নে সুহেলকে (২৬)। বদরগঞ্জ থেকে তিস্তা পর্যন্ত অটোতে আম এনেছেন ১ হাজার টাকা ভাড়ায়। তিস্তা থেকে কুড়িগ্রামে অটো খরচ হয়েছে ৩শ’ টাকা।
১২০০ টাকা মন দরে হাড়িভাঙ্গা আম এনে এখানে ৩৫ থেকে ৪৫টাকা দরে বিক্রি করছেন। প্রতিকেজি আমে ৫ থেকে ১০টাকা লাভ হচ্ছে। করোনার কারণে বিক্রি-বাট্টা কম। ফলে সংসার বাঁচাতে অল্প লাভেই তুষ্ট হতে হচ্ছে তাকে। এমনই অবস্থা এখানকার ফুটপাতের আম বিক্রেতাদের।
শনিবার (৩জুলাই) সকালে কুড়িগ্রাম ধরলা ব্রীজে কথা হয় ওমেদ আলী’র (৫৫) সাথে। রংপুরের মিঠাপুকুরে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
জামাই আরেকটি বিয়ে করেছে। ফলে সংসারে অশান্তি দূর করতে মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে বাড়ী যাচ্ছেন সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের সর্দারপাড়ায়। অটো করে মিঠাপুকুর থেকে জায়গীরহাট পর্যন্ত এসেছেন।
এরপর সেখান থেকে হেঁটে রংপুরের সাথমাথা পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। তারপর অটো করে তিস্তা। তিস্তা থেকে কুড়িগ্রামের ত্রিমোহনী। তারপর ঘোষপাড়া। এখান থেকে হেঁটে তারা ধরলা ব্রীজ পর্যন্ত এসেছেন। চোখে মুখে অশান্তি আর ক্লান্তির ছাপ।
ওমেদ আলী জানালেন, লকডাউনের কারণে অনেক কষ্ট করি মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে আসলাম। জামাই একটা বেয়াদপ ছেলে। ঢাকায় গার্মেন্টেসে কাজ করে।
সেখানে দুটো বিয়ে করেছে। আমার কাছে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে মেয়েকে ৬বছর আগে বিয়ে করেছিল। এখন তার ৪/৫টা বউ। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে মেয়েকে ফেরৎ নিয়ে এসেছি। এ রকম পথে পথে ভোগান্তি আর হতাশা নিয়ে অনেকে চাকুরী হারিয়ে ঢাকা থেকে ভেঙে ভেঙে কুড়িগ্রামে ফিরছেন।
নাগেশ্বরীর কচাকাটার বাসিন্দা ছালাম (২৩) ও মকবুল (২২) জানায়, জুন মাসের অগ্রিম বেতন দিয়ে গত ১২জুন চাকরী গেছে। এখন কেউ লোক নিচ্ছে না। ঢাকায় থাকলে অনেক খরচ। তাই অনেক কষ্ট করে ভেঙে ভেঙে কুড়িগ্রামে আসলাম।
কুড়িগ্রাম শহরের চর হরিকেশ গ্রামের মোজাহার, বাদশা, ছালেক, হামিদ ও লালমিয়ার সাথে কথা হয় ধরলা ব্রীজে। তারা দিনমজুরী করে সংসার চালান। এখন কাজ নেই। তাই ওরা সবাই বড়শি আর জাল নিয়ে ছুটছেন ধরলা নদীর শাখা নালায়।
সেখানে মাছ ধরে পরিবারে আহার যোগারের ব্যবস্থা করছেন। তাদের অনেকের কাছে মাস্ক নেই। উত্তরে মোজাহার আলী জানান, বৃষ্টিতে মাস্ক ভিজে গেছে। গরীব মানুষ বেশি মাস্ক কেনার টাকা নাই।
এই করোনা আর লকডাউন মানুষকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। মানুষের জীবন-জীবিকার বড় ধরণের হুমকী হয়ে এসেছে এই ভাইরাসটি।
স্বাস্থ্য বিভাগ তার ওয়েব সাইটে জানিয়েছে, গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে ৩২জনসহ জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১হাজার ৮৮০ জন। জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে ৪৩জন। এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ২৯ জন ।
অপরদিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুল হাসান জানান, লকডাউনে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শুক্রবার সন্ধ্যায় নয় জনকে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ড দিয়েছে।